নালিতাবাড়ীর গরুর হাট (বর্তমান সার্জেন্ট আহাদ পার্ক)
যখনই চোখ বন্ধ করি মনে হয় যেন সেই পুরনো দিনগুলো ফিরে আসছে। নালিতাবাড়ীর গরুর হাট একসময় ছিল শহরের প্রাণকেন্দ্র,তার ছবি এখনও মনের পর্দায় স্পষ্ট।সপ্তাহে একদিন শহরের প্রাণ জেগে উঠত এই হাটের কলতানে। এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সুসজ্জিত সার্জেন্ট আহাদ পার্ক সেখানে এক সময় ছিল ধুলোমাটির পথঘাটে গড়া সেই কাঁচা হাট আর ঠিক পাশ দিয়েই শান্ত স্রোত বয়ে যেত ভুগাই নদীর।
আমি মিশু তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি। শৈশবের স্মৃতির ঝাঁপিতে অনেক কিছুই সময়ের সঙ্গে মুছে গেলেও হাটে যাওয়ার সেই দিনটি যেন স্থির হয়ে আছে মনে।
একদিন শীতের সকালে বাবা আমাকে ডাকলেন
মিশু চল হাটে যাবি।
একটা পুরনো সোয়েটার গায়ে দিয়ে পায়ে স্যান্ডেল লাগিয়ে আমি বেরিয়ে পড়লাম বাবার সঙ্গে।
রাস্তার ধারে শিশির ভেজা ধানক্ষেত পেরিয়ে আমরা পৌঁছালাম সেই কোলাহলময় হাটে। জায়গাটা যেন প্রাণে ভরা এক চিত্রনাট্য, গরু-মহিষের ডাক বিক্রেতাদের গলা ফাটানো দরদাম, আর চারপাশে মানুষের মেলা।
বাবা সবজি কিনছিলেন আর আমি হাঁ করে তাকিয়ে থাকি বিশাল আকৃতির গরুগুলোর দিকে। কারো গলায় রঙিন ঘণ্টা ঝুলছে, কারো গলায় লাল কাপড়। মনে হত মেলার প্রাণীরা এ হাটের নায়ক।
ঠিক তখনই এক চাচা, মুখটা আজও মনে পড়ে, আমার মাথায় স্নেহভরে হাত রেখে বললেন,
এই যে মিশু কটকটি খাবি।
তার হাতে ধরা ছিল মাটির হাঁড়িতে বানানো কটকটি, ছোট্ট খাঁচার ভেতরে সুন্দরভাবে সাজানো। স্বাদটা আজও জিভে লেগে আছে ঠিক যেমন লেগে আছে শৈশবের শীতার্ত উষ্ণতা।
হাটের একপাশ দিয়ে বয়ে চলা ভুগাই নদী ছিল হাটের শান্তির প্রতিচ্ছবি। লোকজন যখন গরু দেখে, দরদাম করে আমি চুপিচুপি হাঁটতাম নদীর ধার ধরে। সেখানে দাঁড়িয়ে হাটের শব্দ আর নদীর শান্ত ঢেউ,দুটো মিলেমিশে গড়ে তুলত এক অদ্ভুত সঙ্গতি।
আজ যখন ঘুরতে যাই সেই জায়গায় সার্জেন্ট আহাদ পার্ক। যেখানে সিমেন্টের তৈরি স্থাপনে বসে আড্ডা দেওয়া, আর পাকা রাস্তা তখন চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই ধুলোমাখা গরুর হাট আর তার পাশে বয়ে যাওয়া ভুগাই নদী।
জায়গাটা বদলে গেছে সময় অনেক দূর চলে গেছে। কিন্তু আমার ভেতরে একটুও কিছু বদলায়নি।আমি আজও সেই মিশু, যে কাঁপা হাতে কটকটি ধরেছিল, যে গরুগুলোর দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গিয়েছিল, আর যে চুপিচুপি নদীর ধারে দাঁড়িয়ে নিজের ছোট্ট জগৎ গড়ে তুলেছিল।
ভুগাই এখনো বয়ে চলে, কিন্তু আমার ভেতরের নদীটা স্মৃতির নদী সে তো সময়ের কোনো স্রোতে হারিয়ে যায় না।
লেখা: মিঠুন আহমেদ
